Instagram Instagram

Saturday, 19 September 2015

চিন্তাশীল অধ্যয়ন

এক
আগের লেখা বাংলায় অনুবাদ সম্পর্কে নোক্তা দিয়ে শেষ করেছিলাম। বলেছিলাম দর্শনের আলোচনা কিছুটা ফলপ্রসূ হতে পারে যদি আমাদের প্রাথমিক সাধনা হয় বাংলা ভাষার স্বভাবের মধ্যে থেকে সেই ভাষার বাইরের ধ্যানধারণা কতোটা আত্মস্থ করা সম্ভব সেই দিকে আমরা মনোযোগ দিতে পারি। স্বভাব বলতে আমরা প্রমিত বাংলার নিয়ম বা বিধিবিধানের কথা বলছিনা। ভাষার মধ্যে সবসময়ই ভাঙাগড়া চলছে। একটা ‘নিয়ম’ যদি দাঁড়িয়ে যায় তবে তার পেছনে বিস্তর ইতিহাস থাকে। সেই ইতিহাস নিয়মের ইতিহাস নয়, নিয়ম ভাঙাগড়ার ইতিহাস। অর্থাৎ নিয়ম কেউ আইন করে বেঁধে দেয় না, নিয়ম বা বিধিবিধান হিসাবে যা দাঁড়িয়ে যায় তার অন্দরে একটা লম্বা সময়ের ইতিহাস নিহিত থাকে। কিন্তু কোন সৃষ্টিশীল লেখক তাকেই একমাত্র আদর্শ ভাষা বলে মেনে নেয় না, বিদ্যমান প্রমিত ভাষার আইন বা ব্যাকরণ মেনে চললে সাহিত্য মৌলিক বা নতুন কিছু পয়দা করতে পারত কিনা সন্দেহ। ঐতিহাসিক ভাবে হাজির সামাজিক ভাষা যে কোন লেখকের জন্য একই সঙ্গে উপায় আবার বাধা। এই দ্বন্দ্ব মোচনের মধ্য দিয়ে লেখক তার নিজের কন্ঠস্বর তৈয়ার করে নেয়।
আমরা বাংলাভাষার লিখিত-সাহিত্যের ইতিহাসের মধ্যে থেকেই এই লেখাটি লিখছি। ফলে ‘অনুবাদ’ কথাটাকেও এখন যে-ভাষা আমাদের হাতে আছে সেই ভাষায় অনুবাদের কথাই বলছি। এই ভাষা ছাড়াও বাংলাদেশের মানুষের ভাবচর্চার আরও বিশেষ বিশেষ ভাষা আছে; তাদের গাঁথুনি ও আঁটুনি সবসময়ই এই ‘আধুনিক’ বাংলা ভাষার চেয়ে আমার কাছে অনেক বেশী সপ্রাণ ও শক্তিশালী মনে হয়। এই অর্থে যে অন্য ভাষায় দানাবাঁধা চিন্তা আত্মস্থ করবার ক্ষেত্রে সে ভাষা প্রমিত ভাষার তুলনায় অনেক বেশী ক্ষিপ্র, কাব্যগুণ সম্পন্ন এবং কল্পনাকে এমন ভাবে স্পর্শ করতে সক্ষম যাতে বিস্তর কথা সংক্ষেপে বলা সম্ভব। বাংলাদেশের ভাবুকদের গান তার প্রমাণ।
কিন্তু মুশকিল হচ্ছে ভাবের কাব্য গদ্যে রূপান্তরের যে কাজটা সম্পন্ন না হলে চিন্তা বা দর্শন দাঁড়ায় না, বাংলা ভাষায় আমরা সে কাজটা করতে পারি নি। আমাদের গদ্যের ইতিহাস আর কাব্যের ইতিহাসের মধ্যে বিচ্ছেদ এতোই গভীর যে চিন্তা যেমন কাব্যকে অনুপ্রাণিত করতে এখনও অক্ষম, কাব্যও গদ্যকে ভাবচর্চার উপযুক্ত করে গড়ে তুলতে ব্যর্থ। আমার ধারণা বাংলা ভাষায় দর্শন চর্চার দুর্বলতার একমাত্র না হলেও, এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ।
ভাষা ও ভাবের সম্পর্ক নিয়ে আমি পরে ফিরে আসার চেষ্টা করব।। কিন্তু অনুবাদের প্রশ্নটা আমার গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে যখন হুসার্লের লজিকাল ইনভেস্টিগেশান বইটির অনুবাদ আক্ষরিক ভাবে না করে তাকে ‘চিন্তাশীল অধ্যয়ন’করেছি। ‘লজিক’-এর অনুবাদ বাংলায় করা হয়, যুক্তিবিদ্যা – যদিও আক্ষরিক দিক থেকেও সেটা সঠিক অনুবাদ নয়। সঠিক নয় কারন গ্রিক ‘লোজস’-এর মানে যুক্তি নয়। এর আদি মানে ছিল ভিত্তি, আবেদন, মতামত, বর্ণনা এবং কথাবার্তায় যুক্তি থাকা। এই যুক্তি আমরা এখন যেভাবে ‘যুক্তি’কে র্যাীশনালিটি বুঝি তেমন ছিল না। কথা বলতে গিয়ে আগের কথার সঙ্গে পরের কথা যুক্ত না থাকলে কথা বুঝতে অসুবিধা হয়। ফলে ডায়লগের দরকারে কথার সঙ্গে কথা যে যোগ দরকার হয়ে পড়ে সে অর্থে যুক্তি।
তবে ‘লোজোস’-এর যে মানেটা খ্রিস্টিয় ধর্মের ভিত্তি হয়ে উঠেছিল সেটা হোল ‘শব্দ’ বা ‘বাক্য’। ওর মধ্য দিয়েই ঈশ্বর নিজেকে প্রকাশ করেছেন। আর বাক্য আদিতে ঈশ্বরের কাছে ছিলেন। ‘লোজস’এর এই ঈসায়ী ব্যাখ্যা না বুঝলে পরবর্তীতে কালাম আল্লার এবং তিনি তাঁর নবীদের কাছে ‘ওহি’ হিসাবে তা পাঠিয়েছিলেন সেই ইতিহাসও আমরা বুঝবো না। কিন্তু সেটা ভিন্ন বিষয়।
কিন্তু ‘লোজস’ পরে গ্রিক দার্শনিক হেরাক্লিটাসের হাতে ভিন্ন অর্থ পরিগ্রহণ করল। হয়ে উঠল এলোমেলো পরিস্থিতি বা চিন্তার ওপর শৃংখলা আরোপের বিদ্যা। এখান থেকে লজিকের অর্থ ধীরে ধীরে চিন্তার শৃংখলা এবং একসময় যুক্তিবিদ্যা হয়ে উঠল। য়ার এখন যুক্তি বলতে আমরা সাধারণত ইংরেজি রিজন বুঝি।
হুসার্ল ‘লজিক’-কে যুক্তিবিদ্যা হিসাবে ব্যবহার করেন নি, করেছেন চিন্তা হিসাবেই। এই চিন্তা কিভাবে চিন্তা করে তা গবেষণার ক্ষেত্রে বর্ণনাত্মক কিন্তু তন্ময় যে-পদ্ধতি তিনি নিজে অনুসরণ করেছেন তাকেই বলেছেন লজিকাল ইনভেস্টিগেশান। এর সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই আমরা অনুবাদ করেছি ‘চিন্তাশীল অধ্যয়ন’।
একে আমরা চিন্তাশীলতার অধ্যয়ন বলি নি। কারণ চিন্তা এখানে চিন্তার নিজের বাইরের কোন বিষয় নয়, চিন্তা নিজেরই ক্রিয়া। অথচ একই সঙ্গে নিজের বিষয়ও বটে। চিন্তাশীলতার অধ্যয়ন বললে আমাদের চিন্তার বাইরে একজন চিন্তাশীল কর্তার অনুমান করার প্রয়োজন হয়। তার পরিবর্তে আমরা এমন ভাবে অনুবাদ করেছি যাতে বোঝা যায় আমরা তন্ময় অধ্যয়নের কথাই বলছি যা চিন্তায় নিষ্ঠ থেকে বিষয়বিদ্যা করে থাকে। এবার হুসার্ল ও লজিকাল ইনভেস্টিগেশান সম্পর্কে দুই একটি কথা বলব।
দুই
এর আগের লেখায় বলেছি, শিক্ষক হিসাবে ফ্রানৎজ ব্রেনতানোর মস্তো বড় গুণ ছিল প্রশ্ন তোলা আর তাঁর ছাত্রদের ভাবতে বাধ্য করা। দার্শনিকতার খুবই প্রাথমিক মানে হচ্ছে ভাবতে শেখা। মানুষ মাত্রই ভাববার ক্ষমতা রাখে। এক হিসাবে কাউকেই চিন্তাবিদ হবার জন্য বিশেষ কোন শিক্ষা নেবার প্রয়োজন পড়ে না। এর অর্থ এটা নয় যে দার্শনিক হতে হলে কারও কোন ‘শিক্ষা’রই দরকার নাই। সুনির্দিষ্ট ভাবে কোন শিক্ষকের কাছে কিম্বা বিদ্যালয়ে গিয়ে চিন্তা করা শিখতে হবে, ব্যাপারটা ঠিক তাও নয়। আসলে নিজেকে নিজে প্রশ্ন করা এবং সেই প্রশ্ন থেকে উৎপন্ন সিদ্ধান্ত মনে রাখা এবং তার সূত্র ধরে প্রশ্ন থেকে প্রশ্নান্তরে যাওয়া এক বিশেষ ধরণের আগ্রহ বা বৃত্তি যা সকলের থাকে না। কিম্বা থাকলেও সেটা যার আছে তিনি তার চর্চা করেন না।
সাধারণত আমরা আমাদের মনে কোন গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন জাগলেও উত্তর ছাড়াই দিব্যি কাটিয়ে দিতে পারি। আমাদের আশেপাশেই মানুষ যখন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা করে তার গুরুত্ব আমরা প্রায়ই ধরতে পারি না। দর্শনের প্রশ্ন বা ভাবের কথা আমাদের জীব-জীবনের জন্য খুব জরুরী হয়ে ওঠে তাও নয়। অধিকাংশ সময় আমরা তাকে পাত্তা না দিয়ে অনায়াসেই থাকতে পারি। যে প্রশ্ন আমাদের তাৎক্ষণিক ব্যবহারিক জীবনে কাজে লাগে না, সে প্রশ্ন নিয়ে আমরা চিন্তিত হই না। কিন্তু মানুষ মাত্রই প্রশ্নসংকুল; যে-প্রশ্ন সে আজ নিজের মধ্যে দাবিয়ে রাখে কাল অন্যের মুখে সেই প্রশ্ন শুনেই অবাক হয়, বাধ্য হয়ে ভাবে। কিম্বা নিজেই যে-প্রশ্নকে গৌণ মনে করেছিল এক সময় নিজেই তার গুরুত্ব অনুভব করে। এটাও সত্যি, কোন প্রশ্ন ছাড়াই মানুষ জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি তার জীবের জীবন কাটিয়ে দিতে পারে। মানুষ এক বিচিত্র জীব। জীবশক্তি অপচয়ের ক্ষমতা তার অসাধারণ।
ব্রেনতানোর প্রশ্ন করা ও ছাত্রদের ভাবতে বাধ্য করবার ধরণ হুসার্লকে এতোটাই মুগ্ধ করেছিল যে গণিত ছেড়ে হুসার্ল দর্শনে আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন। গণিত আর দর্শন নিয়ে হুসার্লের যে দ্বন্দ্ব সেটা কেটে গিয়েছিল ব্রেনতানোর প্রভাবে। ব্রেনতানোর সঙ্গেই তিনি কাটিয়ে দিলেন ১৮৮৪ থেকে ১৮৮৬ – দুটো বছর। তবে শিক্ষকের কাছে শুরুতে যা শিখেছিলেন তা নিয়ে সেই সময়ের নিস্ফল দর্শনের পরিমণ্ডলে সময়ও অপচয় করলেন কিছুদিন। তাঁর ধারণা ছিল সেই সময়কার দর্শনে চিন্তার যে-পরিমণ্ডল ওর মধ্যে থেকেই তিনি নতুন এক ‘বৈজ্ঞানিক’ দর্শনের জন্ম দিতে পারবেন। তবে শুরু থেকেই তাঁর বৈশিষ্ট্যসূচক একটা দিক ছিল। তিনি ব্রেনতানোর শিক্ষা কাজে খাটাতে চাইলেন সেই বিষয়ের ওপর যা তার আগে থাকতেই জানা। গণিতের দার্শনিক ভিত্তি নিয়েই তিনি তাঁর দার্শনিক চিন্তার জট খোলা শুরু করেন। গণিত কী ধরণের অনুমান, যুক্তি ও চিন্তার ওপর দাঁড়িয়ে আছে, আর সেই গোড়া কতোটা মজবুত তার অন্বেষণই তাঁকে তাঁর নিজের পথ খুঁজে নিতে দারুণ সহায়তা করেছে।
প্রশ্ন তুলেছিলেন সেই সময় যাকে ‘গণিতের যুক্তি’ বলা হোত সেই খোদ ব্যাপারটাই বা আসলে কী? প্রশ্নটা গণিতের তত্ত্ব বা গাণিতিক জ্ঞানের একটা বর্ণনা খাড়া করা না, সেটা তাঁর উদ্দেশ্য নয়। তাঁর মতলব ছিল ভিন্ন। গণিত যে ‘বিষয়’ নিয়ে কারবার করে সে বিষয়টার গঠন, স্বভাব বা চরিত্রটা কী? হুসার্ল বরং এই প্রশ্নটাই খুঁড়তে শুরু করলেন। গণিতের কারবার ‘সংখ্যা’ নিয়ে। তাঁর প্রথম দার্শনিক কাজও তাই সংখ্যা নিয়েই। এই একটি কাজই তাঁকে ইউনিভার্সিটি অফ হালে শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ পাবার সুযোগ করে দিল। তাঁর কাজটা দার্শনিকেরা গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছিলেন; তার আগেই ব্রেনতানো ‘বর্ণনাত্মক মনোবিদ্যা’ হিসাবে দর্শনকে যেভাবে ব্যখ্যা করতে শুরু করেছিলেন হুসার্লের গণিত পর্যালোচনা সে কারণে দার্শনিকদের চোখে ন্যায্যই মনে হয়েছে। হুসার্লকে খুব একটা বেগ পেতে হয় নি।
কিন্তু দ্রুতই হুসার্লের দার্শনিক অন্বেষণ আরও সম্প্রসারিত হোল। তিনি প্রশ্ন করা শুরু করলেন যাকে আমরা চিন্তা বলি তার গোড়ার গঠনটা কেমন? কী ধরনের ধারণা দিয়ে সেই গঠনকে ধরা যায়। পাশাপাশি চিন্তার নানান ‘বিষয়’ নিয়ে পর্যালোচনা তো আছেই। এই প্রশ্ন ধীরে ধীরে ‘লজিক’ বা বৈজ্ঞানিক যুক্তিবিদ্যার গোড়া অন্বেষণে ঠেকল। পাশাপাশি যুক্তিবিদ্যার পদ্ধতিগত দিক ও চর্চার নানান ধরণ নিয়ে গবেষণায় মেতে উঠলেন তিনি যাতে লজিক তার ‘বিষয়’কে কিভাবে ব্যাখ্যা করে তা বোঝা সম্ভবপর হয়। এর কিছু সুফল দার্শনিকদের ঘরে হাতে নাতে পাওয়া শুরু হোল।
প্রথম সুফল হচ্ছে মনোবিদ্যার ভেতর থেকে গড়ে ওঠার ফলে যতোটুকু মনোবিদ্যার প্রভাব ব্রেনতানোর মধ্যে ছিল সেই প্রভাব থেকে দর্শনের মুক্তি। ব্রেনতানোর হাতে চিন্তার কায়কারবার সংক্রান্ত গবেষণা ও পর্যালোচনা মনোবিদ্যার সীমানা ভাঙতে পারে নি। সেটা ভাঙা শুরু হয় হুসার্লের হাতে। ‘বিষয়বিদ্যা’ নিজের পায়ে দাঁড়াবার জন্য বিস্তর শক্তি সঞ্চয় করতে সক্ষম হয়।
দ্বিতীয় লাভ হচ্ছে চিন্তা বা যুক্তির পরিমণ্ডলে দাঁড়িয়ে চিন্তার কায়কারবার বিচার করার সঙ্গে একই বিষয় মনোবিদ্যা-শরীরবিদ্যার ভেতর থেকে বিচার করার মিল ও পার্থক্য সম্পর্কে সেই সময় বেশ বিভ্রান্তি ছিল। হুসার্লের হাতে সে বিভ্রান্তি নিরসন শুরু হয়। মনোবিদ্যা-শরীরবিদ্যার বিষয় নির্ণয় ও বিচারের ক্ষেত্রের সঙ্গে দর্শনের বিচারের বিষয় নির্ণয় ও বিচারের ক্ষেত্রে্র মধ্যে পার্থক্য পরিষ্কার হয়ে ওঠে।
শুরুতে চিন্তাকে যুক্তির স্বভাব দিয়ে বোঝার চেষ্টা ছিল; ফলে যুক্তিবিদ্যার মৌলিক বিষয়াদির চরিত্র নিয়ে হুসার্ল এক যুগেরও বেশী সময় অতিবাহিত করেন। তারই প্রাথমিক ফল হিসাবে দুই খণ্ডে (১৯০০ ১৯০১) তাঁর মৌলিক কাজ ‘চিন্তাশীল অধ্যয়ন’ বা তন্ময় চিন্তার বর্ণনা বইটি বেরোয়। মার্টিন হেইডেগারের মনে করেন ‘বিষয়বিদ্যা’র প্রাথমিক আবিষ্কার ও গোড়া পত্তন ঘটেছে এই দুটো বই প্রকাশের মধ্য দিয়ে। এই দুটো, হেইডেগারের ভাষায়, বিষয়বিদ্যার মৌলিক গ্রন্থ।
হুসার্লের দার্শনিকেরা এই বইয়ের গুরুত্ব তৎক্ষণাৎ বুঝেছেন বলা যাবে না। যদিও ডিলথি (১৮৩৩-১৯১১) বলেছিলেন, কান্টের ‘বিশুদ্ধ চিন্তার পর্যালোচনা’র পর হুসার্লের ‘লজিকাল ইনভেস্টিগেশান’ দর্শনের জগতে বিশাল ঘটনা। মিউনিখ শহরে থিওডর লিপস (১৮৫১ – ১৯১৪) হুসার্লের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন, কিন্তু তার পরেও তাঁর কাছে এই দুটো বই ছিল ‘বর্ণনাত্মক মনোবিদ্যা’র আরও ভাল বয়ান মাত্র। হুসার্লের দার্শনিক আবিষ্কার তিনি ধরতে পারেন নি। অবশ্য এর জন্য হুসার্ল নিজেও কিছুটা দায়ী। তাঁর নিজের কাজ নিজে যেভাবে ব্যাখ্যা করেছেন বিভ্রান্তি সেখান থেকেও তৈয়ার হয়েছে। বইয়ের ভূমিকায় তিনি নিজেও দাবি করেছেন যে বিষয়বিদ্যা হচ্ছে বর্ণনাত্মক মনোবিদ্যা।
অথচ আমাদের মনের আবেগ বা বিবিধ মানসিক বৃত্তি সম্পর্কে হুসার্লের চিন্তাশীল অধ্যয়ন নতুন ও গভীর কোন তথ্য বা ব্যাখ্যা হাজির করে না। আমাদের মনের চাহিদা মেটাবার কোন পথও দেখাতে পারে না। কারণ ‘চিন্তাশীল অধ্যয়ন’ মনস্তত্ত্ব বা মনোবিদ্যার গ্রন্থ নয়।‘চিন্তাশীল অধ্যয়ন’-এর দ্বিতীয় খণ্ডে যে সকল শিরোনামে হুসার্ল আলোচনা করেছেন সেই দিকে নজর দিলেই সেটা পরিষ্কার হয়ে যায়।
হুসার্ল কী নিয়ে আলোচনা করছেন ? একটি খণ্ডের শিরোনাম হচ্ছেঃ ‘বিষয়বিদ্যা ও জ্ঞানতত্ত্ব সংক্রান্ত গবেষণা’। ওর মধ্যে হুসার্ল আলোচনা করেছেন ছয়টি বিষয়। সেগুলো হোল:
এক: প্রকাশ ও অর্থ। ফরাসি দার্শনিক জাক দেরিদা (১৯৩০-২০০৪) ভাষায় প্রকাশ ও তার সঙ্গে অর্থের সম্পর্ক সম্বন্ধে বিষয়বিদ্যার প্রস্তাবনা পর্যালোচনা করেই তাঁর অবিনির্মাণ (Deconstruction) সংক্রান্ত ভাবনা পেশ করতে সক্ষম হন। তার মানে হুসার্লের ‘বিষয়বিদ্যা ও জ্ঞানতত্ত্ব সংক্রান্ত গবেষণা’ এ কালের দর্শনের উল্লম্ফনের ক্ষেত্র তৈরি করেছে।
দুই: বিশেষ ও সামান্যের ঐক্য বা হুসার্লের ভাষায় বিষয়চিন্তার ঐক্য এবং অতি সম্প্রতিকালের বিমূর্ততা সংক্রান্ত তত্ত্ব
তিন: খণ্ড ও অখণ্ড সম্বন্ধে নানান তত্ত্ব প্রসঙ্গে
চার: সাপেক্ষ ও নিরপেক্ষ অর্থের ভেদবিচার এবং বিশুদ্ধ ব্যাকরণের ধারণা
পাঁচ: উপলব্ধির বিষয়াদি এবং তাদের মর্মার্থ
ছয়: বিষয়বিদ্যার পদ্ধতিতে জ্ঞান সম্পর্কে আলোচনার প্রাথমিক উপাদান
বিষয়গুলো স্পষ্টতই মনোবিদ্যা সংক্রান্ত নয়, দর্শনের মামলা।
হেইডেগার হুসার্ল সম্পর্কে এক জায়গায় সংক্ষিপ্ত আলোচনা করতে গিয়ে সঙ্গত কারণেই ‘চিন্তাশীল অধ্যয়ন’ বইয়ের ‘বিষয়বিদ্যা ও জ্ঞানতত্ত্ব সংক্রান্ত আলোচনার এই শিরোনামগুলোকেও বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। শিরোনামেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে কিভাবে বিষয়বিদ্যা দর্শনের প্রধান ক্ষেত্র হয়ে উঠছে এবং হুসার্লের মধ্য দিয়ে শক্তি অর্জন করছে। তবে হেইডেগার বলছেন,
“লজিক বা জ্ঞানতত্ত্বের বই হিসাবে এই শিরোনামগুলোকে অস্বাভাবিকই বলতে হবে। উপশিরোনামে ‘জ্ঞানতত্ত্ব’ কথাটাও বিষয়বিদ্যার ঐতিহ্য থেকে একান্ত ভাবে আলাদা। ভূমিকাতে বলা হয়েছে, আসলে জ্ঞানতত্ত্ব আদৌ কোন তত্ত্বই নয়, বরং ‘নিজের সরল স্বভাবগুনে চিন্তা ও জানার স্তরে যা ঘটে তাকেই চিন্তার নিজের কাছে পরিচ্ছন্ন করে নেওয়া’ একে তত্ত্ব বলা গোপন প্রত্যক্ষবাদিতারই নামান্তর, যার কাছে যে কোন তত্ত্বই হচ্ছে একধরণের অবরোহী পদ্ধতির চর্চা যার উদ্দেশ্য আগাম হাজির থাকা প্রত্যক্ষের ব্যাখ্যা। হুসার্ল পরিষ্কার জ্ঞানতত্ত্ব সম্পর্কে এই ধরণের প্রথাগত ধারণা বাতিল করে দিয়েছেন (Heidegger, 1985, পৃষ্ঠা ২৫)”।
হেইডেগারের কাছে আরও ‘অস্বাভাবিক’ ঠেকেছে হুসার্লের পদ্ধতি। দার্শনিক চিন্তার যে পদ্ধতি হুসার্লের আমলে প্রথাগত, বিধিবদ্ধ বা ঐতিহ্য বলে প্রচলিত ছিল তার সঙ্গেও হুসার্লের চিন্তা বা ‘বিষয়বিদ্যা’র পদ্ধতির কোন মিল ছিল না। ছিল বিপরীত। হুসার্লে ধাপে ধাপে আলোচনা অগ্রসর হয়েছে, যাতে বিষয়ের গভীরে যাওয়া যায়। যে-বিষয় নিয়ে চিন্তা সেই বিষয়কে অনুসরণ করা হয়েছে তন্ময় নিষ্ঠা ও গভীর মনোযোগের সঙ্গে -- যাতে চিন্তা নিজের স্বভাব বশত আগাম যা আন্দাজ করতে সক্ষম হয় তা যথাযথ ভাবে চিন্তায় উদিত হবার সুযোগ পায় এবং সেই উদয়ের ন্যায্যতা প্রতি পদক্ষেপে হুসার্ল পাঠককে দেখিয়ে বা ধরিয়ে দিতে পারেন। বিষয়ের প্রতি তন্ময় নিষ্ঠা পদ্ধতি হিসাবে বিষয়বিদ্যাকে সম্পূর্ণ নতুন এক চরিত্র দান করেছে। কোন বিষয়ের প্রতি তন্ময় নিষ্ঠার বিশেষত্ব আগাগোড়া অনুসরণ না করে হঠাৎ মাঝখান থেকে কোন সিদ্ধান্তের মুহূর্ত ছিঁড়ে নিয়ে অন্য কোন পদ্ধতির মধ্যে কাজে লাগাবার কোন উপায় নাই। বরং এই পদ্ধতি বাধ্য করে যে-বিষয় নিয়ে গবেষণা চলছে তাকে নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে তন্ময় নিষ্ঠায় অনুসরণ করে যেতে, যাতে যা হাজির হয় নি, তা ধীরে ধীরে চিন্তার পরিমণ্ডলে হাজির হতে পারে।
আগামি কিস্তি থেকে আমরা বিষয়বিদ্যার তিনটি অসামান্য আবিষ্কার নিয়ে আলোচনা শুরু করব।

৯ অক্টোবর ২০১৩। ২০ আশ্বিন ১৪২০। শ্যামলী।
লেখক: ফরহাদ মজহার
মূল লেখা পড়তে ক্লিক করুণ চিন্তাশীল অধ্যয়ন

No comments:

Post a Comment